প্রবাস জীবনভ্রমণ/ঘোরাঘুরি

“বগ” এক ভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের সন্ধানে!!!

“Bog” কিংবা বাংলায় লিখতে গেলে বগ। হয় তো বা এ শব্দটির সাথে আমাদের দেশের মানুষ খুব বেশী একটি পরিচিত নয় তবে আপনি যদি যেকোনও ইংরেজি ডিকশনারিতে “Bog” এ শব্দটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন তাহলে দেখবেন যে এর অর্থ দেওয়া হয়েছে এভাবে যে-
“An area of wet muddy ground that is too soft to support a heavy body”.
অর্থাৎ বাংলা করলে দাঁড়ায় যে কোনও একটি অঞ্চল যা প্রকৃতপক্ষে ভেজা কিংবা স্যাঁতসেঁতে এবং কদর্মাক্ত মাটি দ্বারা তৈরী এবং এ অঞ্চলটি কোনও ভারী বস্তুকে ধরে রাখার জন্য খুব বেশী একটি শক্ত নয় অর্থাৎ এ অঞ্চলটি বেশ নরমই বলতে হবে।
কোনও কোনও ডিকশনারিতে আবার “বগ” বলতে বোঝানো হয়েছে কোনও জলাভূমিকে কিংবা অনেক সময় কোনও স্যাঁতসেঁতে ও কর্দমাক্ত ভূমিকে ইঙ্গিত করা হয় এ “বগ” শব্দটি ব্যবহার করে।
জীববিজ্ঞানের কিংবা ভূ-গোলের পরিভাষায় “বগ” হচ্ছে বিশেষ কোনও ধরণের ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল এবং হ্রদ, বিল এবং হাওড় কিংবা পাহাড় অথবা মালভূমি কিংবা সমভূমির মতো “বগ” এরও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং নিজস্ব স্বতন্ত্রতা রয়েছে। অর্থাৎ গতানুগতিক ডিকশনারিগুলোতে যে ধরণের সংজ্ঞা আপনি খুঁজে পাবেন বাস্তবিক জগতে “বগ” অনেকটা ভিন্ন।আর এ ধরণের বিশেষ ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের সন্ধান আপনি পাবেন পৃথিবীর উত্তর প্রান্তে থকা দেশ যেমনঃ লাটভিয়া, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, রাশিয়ার সাইবেরিয়া, নরওয়ে এ সকল জায়গায়।অথবা আপনাকে যেতে হবে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি থাকা কোনও অঞ্চলে যেমনঃ আর্জেন্টিনার পাতাগোনিয়া।



আজকের থেকে দশ হাজার বছর পূর্বের কথা, জীবিজ্ঞানী কিংবা ভূ-গোলবিদদের মতে সে সময়কে বলা হয় “পোস্টগ্ল্যাসিয়াল” যুগ। পৃথিবীর সমুদ্র পৃষ্ঠের অনেক জায়গায় জমে থাকা বরফ সে সময় গলতে আরম্ভ করেছে এবং পৃথিবীর অনেক জায়গায় আজকের দিনের মতো স্থলভাগ সৃষ্টি হতে আরম্ভ করেছে। সে সময় পৃথিবীর আবহাওয়াও উষ্ণ এবং আর্দ্র হতে শুরু করেছে। পৃথিবীর পৃষ্ঠে এ বিশাল পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলের কিংবা দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গার জলাশয়ের তলদেশে সাপ্রোপেলিক নামক এক বিশেষ ধরণের অধঃক্ষেপ সৃষ্টি হতে আরম্ভ করে (সাপ্রোপেলিক অধঃক্ষেপ মূলতঃ বেলেমাটি এবং জমে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণীর অংশবিশেষ থেকে তৈরি হয়)। সাপ্রোপেলিক অধঃক্ষেপ বগ সৃষ্টির প্রথম ধাপ, এরপর আরও এক থেকে দুই হাজার বছর পর অর্থাৎ আনুমানিক আট থেকে নয় হাজার বছর পূর্বে পৃথিবীর আবহাওয়া যখন আরেকটু শুষ্ক হতে শুরু করে তখন পালুডিফিকেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে মস জন্মাতে শুরু করে। আমরা সকলেই জানি যে মস হচ্ছে এক বিশেষ ধরণের অপুষ্পক উদ্ভিদ যা মূলতঃ স্যাঁতসেতে ও ছায়াযুক্ত স্থানে জন্ম লাভ করে, মসবর্গীয় উদ্ভিদগুলোতে কোনও ধরণের পরিবহণ টিস্যু থাকে না এবং এরা থ্যালয়েড অর্থাৎ কোমল কাণ্ড ও পাতা থাকে। এ ধরণের উদ্ভিদে কোনও প্রকৃত মূল থাকে না, মূলের পরিবর্তে রাইজয়েড বিদ্যমান এবং এদের জননাঙ্গ বহুকোষী যা চারদিকে বন্ধ্যাকোষ দ্বারা আবৃত থাকে। ক্রমবর্ধমান সাপ্রোপেলিক অধঃক্ষেপ এবং বিভিন্ন জৈব পদার্থের উপস্থিতি মস বিশেষ করে পীট আর স্প্যাগন্যাম জাতীয় মসের বৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করে এবং সেই সাথে মসের একটি স্তরের সৃষ্টি হয়। এরপর আরও দুই থেকে তিন হাজার বছর পর অর্থাৎ আজকের থেকে পাঁচ কিংবা সাত হাজার বছর পূর্বে অর্থাৎ পোস্টগ্ল্যাসিয়াল যুগের শেষ পর্যায়ে পৃথিবীর পৃষ্ঠের উষ্ণতা এবং আর্দ্রতা যখন মোটামুটি একটা পর্যায়ে উপনীত হয় এ সময় এ সাপ্রোপেলিক অধঃক্ষেপের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায় কিন্তু ভূ-গর্ভস্থ পুষ্টি উপাদানের স্বল্পতার দরুণ এ সময় এ অঞ্চলে থাকা অন্যান্য গাছপালার পরিমাণ  ধীরে ধীরে কমে আসে। যা এ অঞ্চলে মসের বংশবৃদ্ধিতে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায় এবং এরই ধারাবাহিকতায় পূর্বে সৃষ্টি হওয়া মসের স্তরটি ডিকম্পোজড হয় এবং এর ওপর স্তরভিত্তিতে মসের সৃষ্টি হতে থাকে। এটি হচ্ছে বগ সৃষ্টির সেকেন্ডারি ধাপ। এরপর আরও এক থেকে দেড় হাজার পর যখন পৃথিবীর শুষ্ক এবং উষ্ণ আবহাওয়া ক্ষণিকের জন্য মাঝে-মধ্যে আর্দ্রতা দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়া শুরু করলো অর্থাৎ আজকের থেকে তিন চার্ হাজার বছর পূর্বে যখন মসের এ স্তর মোটামুটি একটু পুরু হতে আরম্ভ করলো তখন এ মসগুলো এমন অবস্থায় উপনীত হলো যে তাঁদের পক্ষে মাটি থেকে পানি এবং পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করা সহজ হয়ে উঠলো, এ সময় তখন আবার উদ্ভিদের প্রজনন শুরু হয় এ অঞ্চলে গড়ে উঠা এ মসের স্তরের উপর ভিত্তি করে।এ সকল স্তর এ অঞ্চলের উদ্ভিদকে একটি অবকাঠামো দান করে এবং উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও পুষ্টি উপাদানের উৎস হিসেবে রূপান্তরিত হয়।



আজকের থেকে এক হাজার বছর পূর্বে এখন বগগুলো যে রকম অবস্থায় আছে সে অবস্থায় উপনীত হয়েছে, অর্থাৎ স্তরভিত্তিকভাবে মস জন্মাতে জন্মাতে তা মাটির মতো অবকাঠামো লাভ করে যার উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থানে পৌঁছায়।
অর্থাৎ এ আলোচনা থেকে এটুকু বোঝা যায় যে ক্রমবর্ধমান মসের কারণে বগের গঠন এখনও চলছে এবং একটি বগ সৃষ্টি হতে কমপক্ষে কয়েক হাজার বছর লাগে। বগকে তাই ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে বগ এমন একটি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল যা সৃষ্টি হয়েছে কোনও জলাভূমির তলদেশে সৃষ্ট সাপ্রোপেলিক অধঃক্ষেপ থেকে এবং স্প্যাগন্যাম জাতীয় মসই আসলে এ বগকে পূর্ণতা দান করে।
যেহেতু এ অঞ্চলটি মস থেকে সৃষ্ট তাই এ অঞ্চলের মাটির পিএইচের পরিমাণ অত্যধিক অর্থাৎ অম্লীয় মাটি এখানকার প্রধান ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। তাই এ অঞ্চলে গাছপালার খুব একটি বেশী বৃদ্ধি ঘটে না, মূলতঃ এখানে বেরি, কোনিফার এবং পাইন জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায়। আর মসের আবরণের জন্য এ অঞ্চলের মাটি অনেকটা স্পঞ্জের মতো এবং আপনি যদি এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে আপনার কাছে মনে হবে যে কিছু একটা জিনিস আপনাকে নিচের দিকে টানতে চাইছে। অম্লীয় এবং শুষ্ক পরিবেশের কারণে এ অঞ্চলে জলজ প্রাণী জন্মাতে পারে না তবে গ্রীষ্মকালে এখানে সারস, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির বকের পদচারণা দেখা যায়।
এরকম একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো, এ জায়গাটির নাম হচ্ছে কেমেরি ন্যাশনাল পার্ক যা লাটভিয়ার রাজধানী রিগা থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রিগার সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ট্রেনেই যেতে পারবেন কেমেরি ন্যাশনাল পার্কে এবং ভাড়া পড়বে দেড় ইউরোর মতো। কেমেরির ট্রেন স্টেশন থেকে আরও প্রায় তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয় এ ন্যাশনাল পার্কে পৌঁছাতে।BSCE
স্লোভেনিয়াতে থাকার সুবাদে এবং এখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুবাদে আমি স্লোভেনিয়ার একজন টেম্পোরারি রেসিডেন্স পারমিট হোল্ডার আর যেহেতু স্লোভেনিয়া ও লাটভিয়া দুইটি সেনজেনের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র তাই স্লোভেনিয়ার টেম্পোরারি রেসিডেন্স পারমিট দিয়েই আমি লাটভিয়া ভ্রমণ করেছি। তবে বাংলাদেশ থেকে লাটভিয়া যদি কেউ বেড়াতে আসেন তাহলে অবশ্যই তাঁকে সেনজেন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত এমন কোনও দেশের ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে।

প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ কেউ যদি নতুন কোনও অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে চান তাহলে আপনি আপনার ভ্রমণ তালিকায় কেমেরি ন্যাশনাল পার্ককে রাখতে পারেন।

 



রাকিব হাসান
শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ,
ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স,
ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা,
স্লোভেনিয়া!!!
ফেসবুক মন্তব্য
 
শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen − 6 =

Upcoming Events